ভারত—বাংলাদেশের অবিচল বন্ধু: সহযোগিতার এক অটুট ইতিহাস
“বন্ধুত্বের পরীক্ষায় যারা রক্ত দিয়ে উত্তীর্ণ হয়, তাদের সম্পর্ক সময়ের গণ্ডি মানে না।”

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়, যখন বাংলাদেশ একটি নবজাত জাতি হিসেবে স্বাধীনতার জন্য রক্ত ঝরাচ্ছিল, তখন ভারত শুধু সীমান্ত খুলে দেয়নি, হৃদয়ও খুলে দিয়েছিল। প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয়, রাজনৈতিক সমর্থন, এবং সামরিক সহযোগিতা—সব মিলিয়ে ভারতের অবদান কেবল কূটনৈতিক নয়, মানবিকও ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “ভারত আমাদের শ্রেষ্ঠ বন্ধু।” এই বাক্যটি কেবল কৃতজ্ঞতার প্রকাশ নয়, বরং ভবিষ্যতের এক সম্পর্কের ভিত্তিপ্রস্তর।
উন্নয়নে ভারতের হাত: সহযোগিতার বাস্তব চিত্র
স্বাধীনতার পর ভারত বাংলাদেশের পাশে থেকেছে শুধু কূটনৈতিকভাবে নয়, বরং অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তার মাধ্যমে। ভারতীয় উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সহায়তা স্কিম (IDEAS)-এর অধীনে, ভারতের এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট ব্যাংক (Exim Bank) ঋণ সহায়তা প্রদান করে।
২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত, ভারত ৬৮টি দেশে প্রায় ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ৩০০টিরও বেশি ঋণ সহায়তা (LoC) দিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ একাই পেয়েছে ৭.৮৬ বিলিয়ন ডলার—যা ভারতের Neighbourhood First নীতির বাস্তব প্রতিফলন। এই অর্থে নির্মিত হয়েছে রেলপথ, সেতু, পাইপলাইন, এমনকি ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনও।
"প্রথম LoC, ২০১০ সালে ৮৬২ মিলিয়ন ডলার, ছিল দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের নতুন যুগের সূচনা।"
পরবর্তীতে ৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণসহায়তার মধ্যে বেশ কিছু প্রকল্প ইতিমধ্যেই বাস্তবায়নের পথে—রেলপথ আধুনিকীকরণ, বন্দর উন্নয়ন এবং আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ। এছাড়াও, High Impact Community Development Projects (HICDPs) এবং শিক্ষার্থী ও সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য স্কলারশিপ, দুই দেশের মানুষকে আরও ঘনিষ্ঠ করেছে।
সীমান্ত ও সমুদ্র—শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ও সমুদ্র বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এক অনন্য কূটনৈতিক সাফল্য।
১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে স্বাক্ষরিত সীমান্ত চুক্তি (Land Boundary Agreement / LBA) বহু বছর স্থবির ছিল। ২০১৫ সালে ভারতীয় সংসদের অনুমোদনের মাধ্যমে ১১১টি ভারতীয় ও ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল বিনিময় হয়। হাজারো মানুষের নাগরিকত্বের অনিশ্চয়তা শেষ হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, “ইতিহাসের এক দীর্ঘ অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি।”
২০১৪ সালে, আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত বঙ্গোপসাগরের বিতর্কিত জলসীমা নিয়ে রায় দেয়—বাংলাদেশ পায় প্রায় ১৯,৪৬৭ বর্গকিমি জলসীমা। ভারত বিনা আপত্তিতে রায় মেনে নেয়—দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতিতে বিরল দৃষ্টান্ত।
তিস্তা নদীর পানি বণ্টন ইস্যু এখনও ঝুলে আছে। তবে মোদির বক্তব্য—“নদী বিভাজন নয়, সংযোগের প্রতীক হওয়া উচিত”—দুই দেশের ভবিষ্যৎ সহযোগিতার প্রতীক।
সংযোগ, জ্বালানি ও ডিজিটাল সহযোগিতায় নতুন দিগন্ত
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন কেবল ইতিহাস নয়, এক বহুমাত্রিক ভূ-অর্থনৈতিক বাস্তবতা।
1. সংযোগ: কলকাতা-ঢাকা মৈত্রী এক্সপ্রেস, বন্ধন এক্সপ্রেস, মিতালি এক্সপ্রেস—এই রেলপথগুলো কেবল চলাচলের মাধ্যম নয়, ইতিহাসের পুনর্জন্ম। রাধিকাপুর - বিরল, পেট্রাপোল - বেনাপোল ও আখাউড়া - আগরতলা করিডরগুলো দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক ধমনীকে শক্তিশালী করছে। ভবিষ্যতে, বাংলাদেশ মারফত নেপাল ও ভুটানকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা চলমান।
2. জ্বালানি: ২০১০ সালের বিদ্যুৎ বাণিজ্য চুক্তির পর, বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে ১,১৬০ MW বিদ্যুৎ আমদানি করছে। মৈত্রী পাইপলাইন, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প—এগুলো ভারত-বাংলাদেশ জ্বালানি সহযোগিতার প্রতীক।
3. ডিজিটাল: “স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১ (Smart Bangladesh 2041)” ভিশনের সঙ্গে মিল রেখে ভারত ও বাংলাদেশ কাজ করছে ডিজিটাল গভর্নেন্স, ৫জি সংযোগ, এবং ভারতীয় ইসরোর (ISRO) স্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে। BBIN ডিজিটাল লাইসেন্সিং উদ্যোগ ভবিষ্যতের সংযুক্ত দক্ষিণ এশিয়ার প্রতীক।
উপসংহার: সহযোগিতার নতুন সংজ্ঞা
১৯৭১ থেকে আজ—ভারতের সহযোগিতা বাংলাদেশের পাশে অবিচল। ইতিহাস, ভূগোল ও মানবিকতা একসাথে মিশে এই সম্পর্ককে করেছে অনন্য।
ভারতের নেতৃত্ব শুধু অর্থ বা অবকাঠামো নয়; এটি নৈতিক ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞার প্রতীক। বাংলাদেশের জন্য এই সম্পর্ক কেবল কৃতজ্ঞতার নয়, বরং ভবিষ্যতের দিশা।
"ভারত কেবল প্রতিবেশী নয়—একজন অটল বন্ধু, যার দৃষ্টি ও স্বপ্ন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার সঙ্গে মিলেমিশে আছে।"
এই বন্ধুত্ব প্রমাণ করে—দক্ষিণ এশিয়ার আসল শক্তি প্রতিযোগিতায় নয়, সহযোগিতায়।
What's Your Reaction?






