বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত একের পর এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা ও সশস্ত্র বাহিনীর সাহসিকতা ও দৃঢ় সংকল্প বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছিল। বাংলাদেশের জয় দেশের সামরিক কাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করে। গত ১৫ বছরে সশস্ত্র বাহিনী নিজেদের আধুনিকায়নে উল্লেখযোগ্য সব পদক্ষেপ নিয়েছে, যা তাদের দক্ষতাকে দক্ষিণ এশিয়ার এক শক্তিশালী ও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত সামরিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ''ফোর্সেস গোল ২০৩০'' পরিকল্পনার মাধ্যমে, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর বিবর্তন তাদের কার্যগত সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রতিরক্ষা উন্নয়ন এবং আধুনিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত ঝুঁকির মোকাবিলার এক নতুন আশার আলো নিয়ে এসেছে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের ঐতিহ্য ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পরিচয় তৈরী হল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। ভারতের সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় যৌথ অপারেশন ও কৌশলগত ভাবে একসাথে এগোনোর মাধ্যমে অর্জিত সেই জয় জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা নিশ্চিত করে। সেই ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে ''ফোর্সেস গোল ২০৩০'' পরিকল্পনা চালু করা হয়, যা সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন ও পুনর্গঠনের জন্যই গঠিত হয়েছে। উন্নত অস্ত্র সংগ্রহ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার উন্নতির মতো উদ্যোগের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা যে কোনও সামরিক মোকাবিলার জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে প্রস্তুত করছে। প্রতিরক্ষা বাজেটে ১২৩% বৃদ্ধি এই উদ্যোগের সাফল্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন শাখায় আধুনিকায়ন:
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী:
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যে কোনও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ একটি বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের মধ্যে রয়েছে আধুনিক অস্ত্র, এমবিটি-২০০০ ট্যাংক এবং এমআরএলএসের মতো সাঁজোয়া গাড়ির আমদানি। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সহযোগিতায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্যারা-কমান্ডোদের মতো এলিট ইউনিটের সম্প্রসারণ সন্ত্রাসবাদ দমন ও বিশেষ অভিযান পরিচালনায় সেনাবাহিনীর প্রস্তুতিকে বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ নৌবাহিনী:
উপকূল প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে আঞ্চলিক সামুদ্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। ''ফোর্সেস গোল ২০৩০''-এর অধীনে নেওয়া কৌশলগত উদ্যোগগুলো নৌবাহিনীতে উন্নত ফ্রিগেট, টাইপ ০৩৫জি সাবমেরিন এবং বিএনএস শের-ই-বাংলা ও বিএনএস শেখ হাসিনা-এর মতো নৌ ঘাঁটির সংযোজন নিশ্চিত করেছে। সামুদ্রিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ভারত, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ মহড়া বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে নৌবাহিনীর সক্ষমতা বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনী:
বাংলাদেশ বিমানবাহিনী তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা শক্তি বাড়ানোর জন্য চরম উন্নতির সাক্ষ্য রেখেছে। মিগ-২৯ ফাইটার জেট, আধুনিক পরিবহন বিমান এবং রাডার সিস্টেম আপগ্রেডের মাধ্যমে এয়ারস্পেস নিরাপত্তা শক্তিশালী করা হয়েছে। পাশাপাশি, নজরদারি ও গোয়েন্দা কার্যক্রমের জন্য ড্রোন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে উদ্ভাবন ও আত্মনির্ভরশীলতার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
আঞ্চলিক প্রভাব ও ভবিষ্যতের লক্ষ্য:
বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী এক শান্তির দূত হিসেবে উঠে এসেছে। ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, বিশেষ করে সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহে ৫০ কোটি ডলারের লাইন অব ক্রেডিট ব্যবহার, সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতাকে আরও উন্নত করেছে। ভবিষ্যতের জন্য ফোর্সেস গোল ২০৩০, স্বনির্ভরভাবে সামরিক অস্ত্র উৎপাদন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ড্রোন ও মহাকাশ প্রযুক্তির মতো ক্ষেত্রগুলোতে দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করছে।
পরিশেষে:
১৯৭১ সালের সাহসিকতা থেকে শুরু করে আধুনিক সামরিক শক্তি হয়ে ওঠা পর্যন্ত বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী এক স্থায়িত্ব ও অগ্রগতির অন্যতম এক নিদর্শন। কৌশলগত বিনিয়োগ, আঞ্চলিক অংশীদারিত্ব এবং উদ্ভাবনের উপর জোর দিয়ে, সশস্ত্র বাহিনী যে কোনও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত। দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি, শক্তি ও স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত শুভ ও বাস্তবসম্মত।